বিশ্ব বিরহদিবস ৩০ জুন
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম হাবিবী, লন্ডন থেকেশিরোনাম দেখে ভ্রু কুচকাবেন না, প্লিজ। বলবেন না, এত বড় একটি পবিত্র দিনেও লোকটির মনে উল্টো জোয়ার। সারা বিশ্বে যখন ভালবাসা দিবস বা ভালেন্টাইন'স ডে পালিত হয়-বলা যায় যথাযথ মর্যাদার সাথে (হয়ত একদিন রাষ্ট্রীয়ভাবেও পালিত হবে, রাষ্ট্রপ্রধান বাণী দেবেন, পত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্র বেরুবে), সেখানে এবং সেই মূহুর্তে আমি 'সেকদিবস' বা 'বিশ্ব বিরহদিবস' পালন করছি, প্রবন্ধ লিখছি, পত্রিকায় প্রকাশও করছি। আসলে আপনাদের কষ্ট আমি বুঝি। তবে আপনাদেরও মনে রাখতে বলি যে, মতামতটি একান্ত আমার। আমি যদি বলি, কোন একটি গ্রহে ফুল ফোটে কষ্টের তাপে, তাতে তো আপনি রাগ করতে পারেন না।
ফরাসীরা 'স্যঁ ভালোস্তা' বলে 'কমিউন' বা কমিউনিটিকেও জানে, সেখানে সব ধরণের কপোত-কপোতির প্রবেশাধিকার নেই।এর অর্থ হল, প্রেমেও শ্রেণী বিন্যাস আছে। ইতালীতে এই নামের একটি গেইট আছে, যেখানে নারী-পুরুষের সম্পর্ককে মেনে নিয়েছিলেন বলে খ্রিস্টান ধর্ম যাজকের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল।
আসলে ভালেন্টাইন'স ডে'র ইতিহাস নিয়েও আছে গোঁজামিল। নানান মত।পাখির বিবাহ, রোমীয় জুনো দেবীর নামে ছুটি, চক্ষু দান এবং ফ্রেন্স কবির জেল-জীবন ইত্যাদি। ভালবাসা দিবসের সূচনা ২৬৯ খৃষ্টাব্দ নয়, তার শুরু আদম সন্তান হাবিল-কাবিলের বিবাহ বিষয়ে রক্তপাতের দিন থেকে।
সে দিন সেখানে কোন প্রকার ভালবাসাবাসি ছিল না, ছিল খোদা প্রদত্ত আদেশ পালনের এষণা। সে আশায় প্রেম না এসেও বিরহ এসেছিল। বলা যায়, প্রথম বিরহ, তারপর প্রেম। প্রেমের জন্য বিরহের প্রয়োজন। সম্রাট শাহজাহান তাজমহলের মর্মর পাথরের কারুকাজে বিরহকেই তো বাঁচিয়ে রেখেছেন। তিনি বিরহকে ভালবাসতেন বলে তাজমহল নির্মিত হয়েছিল স্ত্রীর জীবদ্দশায়।
নামেও কিছু আসে যায়
ইংরেজি Love, বাংলার প্রেম-ভালবাসা সমান্তরাল নয়। Love দিয়ে বিস্তৃত অর্থ প্রকাশ করা যায়। প্রেম এর প্রবেশ সর্বত্র অননুমোদিত। আপেক্ষিক। বাংলার 'ভালবাসা সিমায়িত। বাংলায় 'লাভ' মানে স্বার্থ; যেমন অর্থ-বিত্ত, না হয় রূপ-লাবণ্য। সাহিত্যের সর্বত্র রূপের পুঁজো। সুন্দরীগণ প্রেম বিষয়ে জানে আগে, বুঝে পরে, কাদেঁও বেশী। আমার একটি নাটকের নাম, 'ভালবাসার হাত পা'। '৯৯ ভার্সিটির রেগ ডে'র মঞ্চে একটি গান গেয়েছিলাম। 'রূপ বিহীনার প্রেম হায় কানা...। অনেকেই লাভ এবং লোভের আশায় Love করে। বলা যায়, The worship of Mammon. 'প্রতি অঙ্গ লাগি প্রতি অঙ্গ'র কান্না। এই জন্যেই জার্মানরা Love বলতে 'লিভে' উচ্চারণ ভেদে লিভার কে বুঝে। লিভার থাকে পেটের পাশেই। পকেট ফতুর, খাও, গাও সময় বুঝে ধাও, মানে উধাও হয়ে যাও। অন্যের হাত ধরে বনে যাও পূত-শুচিতা। আর স্পেনীশদের কাছে প্রেম মানে 'ভণিতা'।বাংলায় এর অর্থ সবার জানা। আরবিতে প্রেম শব্দের তরজুমা 'উদ'ও হয়। বাংলায় উদ একটি প্রাণীর নাম, -যে জলে-পুকুরে ডুব দিয়ে চুরি করে মাছ খায়। প্রেমও তো তাই, আসে চুপে চুপে, চুরি করে।
তাই সম্ভবত: টেনিসের জিরো পয়েন্টের নাম Love. তা হলে কি ধরে নেব যে, ইংরেজরাও প্রেম বলতে সেক মানে কষ্ট বা জিরো অথবা শুন্যকে বুঝে? ফিলিপিনদের কাছে Love এর অর্থ pag-ibig. শব্দটি noun. কর্মবাচ্যে এর প্রতিশব্দ নেই। জাপানিদের প্রেম 'রা নাই'।সোজা অর্থ হল, প্রেমে পড়, মর, নো হায়-হুতাশ, নো সাউন্ড। শব্দ করলে পরিবার থেকে খাবেন কিল এবং সমাজ থেকে ঢিল।
এ রকম আরো একটি মজারদার শব্দের সন্ধান পেয়েছি তার্কিশ ডিকশনারিতে। তাদের কাছে Love অর্থ সবজী বা সেবজী। মানেটা কি? খাও আর খেতে দাও। তবে 'ভেজেটেরিয়ান লাভ'। সোমালিয়ানদের কাছে প্রেম এর অর্থ 'জালাই হা'। বাংলায় তরজুমা করে যদি বলি ' জ্বালায় খা'-কেমন হয়? কারণ, প্রেমে পড়লে জ্বালা পেতে হবে সন্দেহ নেই। ঐ যে গ্রামে বলে, 'প্রেমের নাম বেদনা'। বেদনা শব্দের দুটি অর্থ, কষ্ট এবং বেদনা (এক প্রকার ফল)। গুরুমম্ভির বাক্যে বলি, জ্ঞানীদের প্রেম কষ্টের, গরীবের প্রেম বেদনার। ভালবাসা পেতে হলে ভাল বাসার প্রয়োজন। আমি একজনকে জানি, যার শহরে ভাল বাসা বা বাড়ি ছিল না বলে তাকে 'সাধের লাউ' এর ডুগডুগি বাজাতে হয়েছিল।
মরা ও মরমী
সেক-ডে বা বিরহদিবস পালন করা দোষের নয়। প্রেমের বিপরীত শব্দ সেক বা ছেক। এই ছেক থেকে আসে বিরহ। সেক শব্দটি যথোচিৎ তবে বিরহ ভদ্রজনোচিৎ। সেক আছে বলেই তো প্রেমে মজা।একটু এগিয়ে বলি, সেক প্রেমের বড় ভাই। বড় ভাই যেমন বাবার মত শাসন করে, সেকও প্রেমকে এগিয়ে নিয়ে যায়। শক্তি আনে, সাহস জোগায়। ছেকায় যেমন আটার খামির পুড়ে রুটি হয়, কামার ও কুমার মাটি পুড়ে গড়ে ব্যবহার্য সামগ্রী। পুড়লেই সোনা খাঁটি হয়। ভাত-তরকারী পুড়লেই খাবার হয়। প্রেমও তেমন। আজ যারা বিখ্যাত তারা জীবনে বহুবার, বহুভাবে সেকা খেয়েছেন। হয়ত তারা বলেন না। কিনতু আপনি এদের চেনেন। আমিও কয়েকজনকে জানি। সেকা খাওয়া মুরুব্বিরা বলেছেন, 'Love, and a cough, can not be hid'. চাঁটগাইয়্যা শেফালী ঘোষ গেয়েছেন, 'ঢোলর বারি হড়র তলে হ দিন থাকিব'।থাকে না।
সেই শেক্সপিয়র, বার্ণাড শ, সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা কার্লমাক্স, লেনিন, বিশ্ব বিখ্যাত ফার্সি কবি ওমর খৈয়ামের একটি তিলকের কাছে বোখারা রাজ্য বিলিয়ে দেয়া, ইংল্যান্ডের প্রিন্স এর সিংহাসন ত্যাগ, ডায়েনার চালর্স আরো অনেকেই। সে দিনও বিদ্রোহের কবি বল্লেন, 'হে মোর রাণী, তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে, আমার বিজয় কেতন উড়াই তোমার চরণ তলে এসে'। সব চেয়ে বেশী সমর্পিত ছিলেন আমাদের এই আমামা এবং দামামার কবি। রবীন্দ্রনাথেও প্রেমাঘাত আছে। আছে অসহ বিরহ দহ।'আমি যারে চাই তারে নাহি পাই, যারে পাই তারে চাই না'-হল সেকা'র কবিতা, আর ' হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে তোমায় পাই নি'.., বিরহের দহ।
যাকে নিয়ে এই ভালেন্টাইন'স ডে, সেও তো সেকা খেয়েছেন। বিরহে জ্বলেছেন। মজেছেন। মজাতে পারেন নি। লাইল-মজনু, শিরি-ফরহাদ, ইউসুফ-জোলেখা, চন্ডিদাস-রজকিনী, রোমিও-জুলিয়েট, হিরো-লিয়েন্ডার, যাকে নিয়ে নজরুল লিখেছেন,'আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী, মহাসিন্ধু ঘুমঘুম' সেই অর্ফিয়াস-ইউরিডাইস, পুরূরবা-উর্বশী, গ্রীকদের অ্যাকোন্টিয়াম-সাইডিপি, পুরাণের রুরু-প্রমদ্বরা, দেবযানি-কচ ও সতী-মহাদেব, যাকে নিয়ে রোমিও-জুলিয়েটের আবিস্কার সেই পারমিউস-থিসবি সবই তো ব্যর্থতার, সেকার বা বিরহের, বেদনার, কষ্টের, লাঞ্চনার, বঞ্চনার ইতিবৃত্ত ও ইতিহাস!
স্বীয় চরকা
আমার ছাত্র জীবন ছিল বড়ই 'করুণরসে' পূর্ণ। পরিবারে এবং সমাজে অনেকটা অবাধ্যজন হিসেবে আমার পরিচিতি ছিল। সবাই বলতেন, 'ও কিছু হবে না'। প্রাইমারি স্কুল থেকে ঘরছাড়া-স্বেচ্ছায় নির্বাসন। সেখান থেকে ভার্সিটি, সাহিত্য সংগঠন, গান, কবিতা, নাটক, '৮৯ সালের রেগ-ডের বাউল, '৮৮ এর ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্তদের সাহায্যের আবেদন জানিয়ে রাস্তায়, গ্রামে-গঞ্জে হেঁটে হেঁটে গান গাওয়া, পত্রিকা-রেডিওতে কাজ, লেখালেখি, শিক্ষকতা, সর্বশেষ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ছাত্রত্ব গ্রহণ; এ সব কিছুর পিছনে আমাকে প্রচুর ছুটতে হয়েছে। অক্লান্ত।
চলার পথে অনেকের সাথে দেখা, পরিচয় হয়েছে।
জীবনের বিচিত্র গলিতে প্রেম-ভালোবাসাকে আমি বিভিন্নভাবে দেখেছি। বালিয়াড়ি এবং মরিচিকার মত প্রেম-ভালোবাসার সহজ কোন ব্যাখ্যা নেই। প্রেম এই আছে, এই নাই। আসে। যায়। এলে দহ। গেলে বিরহ। কাছে এলে বলি 'কেন যায় না'। গেলে বলি, 'হায়! হায়'!!
ছড়ায় বলি, ভালবাসা মিউ মিউ/ অবুঝ বুঝের বুঝ
জীবনধারার নাদান কিউ/ দুই মনের ত্রিভূজ।
আপনি যখন বলেন, 'Love is Heaven' তখন আলাউদ্দিন আল আজাদ বলেন, 'জন্মাদ্ধ ভালবাসা তুমি আমার/ তোমার নিয়ে আমার চরম দুর্দশা। রবীন্দ্র গোপ আরো কঠিন। তিনি বলেন, ' ভালবাসা অভিশাপ/ ফনা মেলে বিষধর সাপ'। ইংরেজিতে আছে: 'Love is game in which both player cheat'. আরবি শব্দ 'লাভ' অর্থও Game। কী অদ্ভুত মিল! এই সব গুণিজনদের কথা মেনে নিয়ে ভালবাসা দিবসে আমি চাইলে বিরহ দিবসও পালন করতে পারি।
এবং তাই
পৃথিবীর অনেকেই প্রেমের জয়গান গেয়েছেন। আসলে তারা ভেতরে ভেতর সাগর সাহারা। বৈরাগী। বর্তমানের সাধু-সন্ত।
ভাবগম্ভীর কথা বলে অশ্রু লুকাবার ছল করেন মাত্র। ব্যর্থরাই বিজ্ঞ সেজে পরবর্তী প্রজন্মকে সস্তা উপদেশ বিতরণ করেন। তারা বলেন, 'বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলে দেয়', বলি, সাধু, সাধু! কী সাংঘাতিক ছলনা, মর্মান্তিক গুরুগিরী! সেকা ঢাকার ঢাকঢোল সম্ভবত:। প্রেমের ল্যাং খেয়ে জীবনের অথৈ জলে 'আমায় ভাসাইলিরে, আমায় ডুবাইলিরে' গাইবেন আর নবদর্শন দেবেন তা তো হয় না।
সাহিত্যের আশি ভাগ জুড়ে আছে প্রেম-শ্যাম, আর প্রতি ছত্রে-মাত্রায় সেই বিখ্যাত গান-'তুমি কি দেখছো কভু জীবনের পরাজয়'.., অথবা, '…পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই', অথবা 'ভালবাসিয়া গেলাম ফাঁসিয়া..'! অর্থাৎ সর্বত্র হায় হুতাশ! দীর্ঘ শ্বাস!
ভালবাসা দিবসের জমকালো আয়োজনের মধ্যেও আপনি যদি একটু চোখ খুলে দেখেন, দেখবেন, গাছের আড়ালে, লেকের ধারে, কোন ঝর্ণা ধারার স্নিগ্ধসুশীতল মৃদুমলয়ে, ক্যাফে বা চেপে অজস্র অশ্রুধারা। টপ টপ। দীর্ঘশ্বাস ও বিরহের দহন কেউ দেখে না। হয়ত জানে গাছের পাতারা, বায়ু, ঘাষ এবং প্রজাপতি; যাদের নিকেটে এই যুগল ছিল। লন্ডনের টেমস, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি এবং ফয়েজলেকের জলও কিছুটা অবগত যে, বিরহ, ব্যর্থ-ব্যথা, দলিত, মথিতপ্রাণ নির্গত কি পরিমান অশ্রুতে এরা সিক্ত! এর মধ্যেও যারা হাসছেন, গাচ্ছেন, সুখি দম্পতির নিশান উড়িয়ে ছুটছেন হাওয়ার তালে তালে, তারাও সুখে নেই। তারা অভিনয় করেছন একটু প্রশান্তির অন্বেষায়-তৃষায়।
আমরা যখন ভালবাসা দিবস করি তখন এক কঠিন বাস্তবতাকে ভুলে যাই। ভালবাসা দিবসের দিন রমনার বটমূলে, দুটি আলাদা মঞ্চ তৈরি করে, মাইক দিয়ে এক দলকে বলুন গাইতে, আরেক দলকে বলুন কাঁদতে। সন্দেহ নেই যে, দ্বিতীয় দল ভারি হবে; কান্নার আওয়াজে হেরে যাবে নতুন মজনুরা। ভেসে যাবে Puppy love.
আমি ফ্রান্স সহ ইউরোপের অনেকগুলি দেশ ভ্রমণ করেছি। সেই 'বলোইনেরবন' এর দুইবৃক্ষের ধারে বসে 'জো তেইম শেরী' বলার মধ্যে দেখেছি চোখের জলও! আমার ফ্রেন্স বান্ধবী ৩৫ বছর পরও জানে না ভালেন্টাইন'স ডে প্রকৃত অর্থ কি।!
আর এই আমিও একজনের জন্য সেই ১৯৮৬ থেকে প্রতিক্ষণ অপেক্ষা করি।
তাকেঁ খুজিঁ আরেক জনের মধ্যে। কী মধুময়-অমিয় বিরহ!
পুন্শচ: আমি ১৯৮৬ থেকে ৩০ জুনকে 'বিশ্ব বিরহদিবস' হিসেবে পালন করে আসছি। আপনার যারা (নারী বা পুরুষ) সেকায় জ্বলে, পুড়ে, আছার, জুতো, গুতো, কিল, ঢিল, অর্ধচন্দ্র বা পুরোচন্দ্র খেয়ে, লাঞ্চিত, বঞ্চিত, প্রতারিত, বিতাড়িত, প্রত্যাখ্যাত, পদদলিত এবং অবহেলিত হয়ে, মরে মরে বেঁচে আছেন তাঁরা যেন ৩০ জুন লন্ডনের আলতাব আলী পার্কে আসেন। ১৫.১০.২০১০ ইংরেজি, লন্ডন।
sagarsahara@hotmail.com