09 May 2010 :: 11:18 am
বড়শি দিয়ে ডিঙি নৌকায় চড়ে মাছ ধরছেন সামছুদ্দিন ভাংগী। ধান ও বাদাম তলিয়ে গেছে তাই সাতজনের সংসারের এই কর্তাকে মাছ ধরে তা বিক্রি করে পরিবারের সদস্যদের মুখে আহার দিতে হয়। শুধু সামছুদ্দিন নন, বর্ষায় চরাঞ্চলের জমি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় অধিকাংশ চরের বাসিন্দাকে মাছ ধরার ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। ফলে বিস্তৃত পদ্মা নদীতে বাড়ছে মাছ ধরার অবৈধ বাঁধ। তাও একটি দুটি নয়। রবিবার পর্যন্ত কমপক্ষে অর্ধ শতাধিক অবৈধ বাঁধ স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিদিনই বাড়ছে এই অবৈধ বাঁধের সংখ্যা। গত ৭ থেকে ১০ দিনে পানি বৃদ্ধির ফলে এখন শিবচরের পদ্মায় অবৈধ নদী জোড়া আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে পোনা মাছ, ডিমওয়ালা মাছ, জাটকাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ নিধনের মহোৎসব চলছে। তাই চরাঞ্চলের ফসল হারানো হাজার হাজার হতদরিদ্র কৃষক শেষ ভরসা মাছ ধরা থেকে বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কায় হতাশ হয়ে পড়েছেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন সবাই বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও যেন দেখার কেউ নেই। খোদ মৎস্য অফিস সূত্র জানিয়েছে, তাদের নেই অভিযান চালানোর আইনগত ক্ষমতা। এ সুযোগে অপতৎপরতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মাওয়া-কাওরাকান্দি রুটের মূল চ্যানেলেও দেখা গেছে এ অবৈধ বাঁধ। ফলে নৌযান চলাচলেও বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। সরেজমিনে পদ্মা নদী ঘুরে দেখা গেছে, কাওরাকান্দি ফেরিঘাটসংলগ্ন পদ্মায়, জনবিচ্ছিন্ন চরজানাজাতের কাওলিপাড়া, চরচান্দ্রা, জলসন, নেপালের হাওর, পোড়াকান্দিরখোল, মীর আলী সরদারকান্দি, বাড়ইকান্দি, চানবেপারিকান্দি, কাঁঠালবাড়ী, মাগুরখণ্ড, মাদবরচর, বন্দখোলা ইউনিয়নের চরাঞ্চলে নদীজুড়ে আড়াআড়ি প্রায় অর্ধশতাধিক বাঁধ দিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ নির্বিচারে নিধন চলছে। একেকটি বাঁধ ২০০ মিটার থেকে ৬০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। বাঁধগুলোতে অসংখ্য বাঁশ গেড়ে মশারি, ছালা বা কারেন্ট জাল দিয়ে ঘেরা। নিচে মাছ আটকানোর দোয়াইর ও বড়শি। ফলে জাটকা, চিংড়ি, রুই, কাতলা, আইড়, পাঙ্গাস, বোয়ালের মা মাছ ও পোনাসহ বিভিন্ন মাছ আটকা পড়ছে। বাঁধগুলোতে ব্যবহৃত জাল দিয়ে এক ইঞ্চির পোনা মাছ বের হওয়ারও সুযোগ নেই। অথচ সাড়ে চার সেন্টিমিটারের নিচে ফাঁসযুক্ত জাল ব্যবহার ও নদীতে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতামূলক বাঁধ দেওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। এদিকে চরাঞ্চলে আরো অর্ধ সহস্রাধিক অবৈধ বাঁধ তৈরির প্রস্তুতি চলছে। এসব বাঁধের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা জড়িত বলে জেলেরা অভিযোগ করেন। তবে বাঁধগুলোর অধিকাংশ মাছ শিকারী সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে সটকে পড়ে।
দক্ষিণ চরজানাজাত এলাকার একটি অবৈধ বাঁধের জেলে করিম মিয়া জানান, সেখপুরের জনৈক ব্যক্তি এই বাঁধ দিয়েছে। তাঁকে দৈনিক বেতনে রেখেছে। এই বাঁধে ছোট-বড় সব ধরনের মাছই ধরা পড়ে।
সাধারণ পদ্ধতিতে মাছ ধরতে থাকা জেলে ইউনুছ বলেন, 'যে বানগুলা (বাঁধ) দেহেন। এইগুলা সব বাইরের মাইনষে দিছে। চরের মাইনষের কি এত টাহা আছে? এহন আর কয়ডা বান। সামনে শত শত বান দিব। তাতে চরের হাজার হাজার মাইনষের কোনো উপকার হয় না। এই বছর চরের কৃষকের সব ফসল নষ্ট হইছে। মাছও যদি না পায় কেমনে চলব?' চন্দ্রপাড়া এলাকার জেলে দলের সর্দার আফসার উদ্দিন বলেন, 'মূল পদ্মায়ও বান আছে। ফেরিতে যে মন্ত্রী আর অফিসাররা যায় তারা কি চোহে দেহে না? নদীতে কী হইতাছে।'
চরজানাজাত ইউপি চেয়ারম্যান বজলু সরকার বলেন, 'পদ্মায় পানি বাড়ায় ইতিমধ্যেই অর্ধশতাধিক অবৈধ বাঁধ দিয়ে নির্বিচারে পোনা মাছ ও মা মাছসহ সব ধরনের মাছ নিধন শুরু হয়েছে। বাহিরের মানুষ টাকা দিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে বর্ষায় শত শত বাঁধ দিয়ে মাছ শিকার করে।'
শিবচর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মনিরুল মামুন বলেন, 'মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলের নদীতে অভিযান চালানো দুরূহ হওয়ায় বাঁধের সংখ্যা বেড়ে গেছে। তা ছাড়া আমরা মৎস্য অধিদপ্তরের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হলেও কোনো অভিযান চালাতে হলে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। আইনগতভাবে মৎস্য বিভাগ অভিযান চালাতে পারে না। এ ছাড়া বাঁধ অপসারণের জন্য বাজেটও অপ্রতুল।' এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, 'নদীতে কোনো প্রকার বাঁধ দেওয়ার সুযোগ নেই। এটি সম্পূর্ণ অবৈধ। আমি বিষয়টি জেনেছি। শিগগিরই চরাঞ্চলে অভিযান চালিয়ে সব বাঁধ অপসারণ করা হবে।'

