মাওয়া-কাওড়াকান্দি নৌরুটের সার্ভে ও ফিটনেসবিহীন মেয়াদোত্তীর্ণ ফেরিতে অত্যন্ত ঝূকিপূর্ণভাবে প্রতিদিন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের হাজার হাজার যানবাহন ও যাত্রী পারাপার হচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা রক্ষায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা বিআইডবিউটিসি নদীপথে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখলেও চলতি ঝড়ের মৌসুমে যান ও মাল চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে যাত্রীদের অভিযোগ। ফলে নৌপথে নিরাপদে যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে চরম শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এমনকি মন্ত্রীসহ ভিভিআইপিদের বহনকারী ফেরিটিরও ৫ বছর ধরে সার্ভে হয়নি। ফলে চলমান বর্ষা মৌসুমে রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ ভিভিআইপিসহ হাজার হাজার যাত্রী ও যানমাল চরম ঝুঁকির মধ্যে উত্তাল পদ্মা পাড়ি দিচ্ছেন। সূত্র জানায়, এ রুটে চলাচলকারী ১০টি ফেরির সব কটি ফেরিই ৫০-৬০ বছরের পুরোনো। ফেরিগুলো সচলের চেয়ে বিকলই থাকে বেশি সময় ধরে। ১৮ কিলোমিটার দূরত্বের দীর্ঘ ডুবোচরে ভরা এ নৌরুটে দীর্ঘদিন চলতে চলতে ফেরির পেট পাতলা হয়ে জং ধরে ও মরিচা পড়ে পেটের জোড়াগুলো আলগা হয়ে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এছাড়াও এ রুটের নাওডুবা-মাগুরখণ্ড-মাওয়া চ্যানেলটি অত্যন্ত সরু হওয়ায় সামান্য বাতাসেই ডুবোচরে সংঘর্ষ হওয়ায় ফেরিগুলোর প্রপেলারে প্রতিনিয়তই চিড় ধরে সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। সূত্রের অভিযোগ, প্রতি বছর সার্ভে করার নিয়ম থাকলেও কোনো ফেরিরই গত ৪/৫ বছরের বেশি সময় ধরে সার্ভে না করায় ঝুঁকি বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। সম্প্রতি অর্ধশত বছরের পুরোনো ডাম্ব ফেরি রায়পুরা তলা ও পাশে ছিদ্র হয়ে ২২টি যানবাহন ও তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে পদ্মার বুকে ডুবতে বসেছিল। পরে ৬টি পাম্প মেশিন বসিয়ে ও শরীয়তপুর ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট এসে মধ্যরাতে ফেরিটিকে উদ্ধার করা হয়। রায়পুরার মতোই এ রুটে পাতলা পেট, জং ধরা ও মরিচা পড়া দীর্ঘদিনের আরো ১০টি ফেরি চলছে। ভিভিআইপিদের পারাপারে ব্যবহৃত কেট আই ধরনের সিঙ্গেল ফেরি কর্ণফুলীর অবস্থাও একই রকম। থোবাল ও রানীক্ষেতসহ সব ফেরিই প্রতিনিয়ত পানি ডাম্পিং করে বিপজ্জনকভাবে চালানো হচ্ছে। এ রুটে চলাচলকারী অর্ধ শতাধিক ফিটনেসবিহীন লঞ্চও প্রতিদিন চরম ঝুঁকির মধ্য দিয়ে উত্তাল পদ্মা নদী পাড়ি দিচ্ছে। বিআইডবিউটিসির একাধিক সূত্র জানায়, এ রুটে চলাচলকারী ফেরি ১৯৭৮ সালে নির্মিত ৮-৩৯০ আইটি (টাগটি) ২০০৫ সালের এপ্রিলে, ১৯৭৮ সালে নির্মিত ৮-৩৯১ আইটি (টাগটি) ২০০৬ সালের মার্চে, ১৯৭৫ সালে নির্মিত ৮-৩৯৪ আইটি (টাগ) ২০০৮ সালে ফেব্রুয়ারিতে, ১৯৭৫ সালে নির্মিত ৮-৩৯৫ আইটি ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ১৯৭৬ সালে নির্মিত ৮-৩৯৭ আইটিটি ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ১৯৬১ সালে নির্মিত আইটি বেলজিয়াম ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ১৯৬৫ সালে নির্মিত আইটি ইরান ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এবং মিডিয়াম টাইপ ফেরির মধ্যে ১৯৬৩ সালে নির্মিত ফেরি যশোর ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরের পর থেকে সার্ভে করা হয় না। এছাড়াও ফ্লাট ফেরিগুলোর মধ্যে ১৯৩৮ সালে নির্মিত থোবাল ও যমুনা, ১৯২৫ সালে নির্মিত রানীক্ষেত, রায়পুরা, রানীগঞ্জ ও টাপলো, ১৯৭৩ সালে নির্মিত ফেরি কেটাইপ কুমারী, কামিনী ও ১৯৬৩ সালে নির্মিত ভিভিআইপি ফেরি কর্ণফুলীসহ উল্লিখিত ফেরিগুলো গত ৫ বছর ধরে সার্ভে করা হয়নি। ফলে সব ফেরিগুলোই সার্ভে সার্টিফিকেট ছাড়া ঘন ঘন ডকিং (মেরামত) করে চলছে। ফেরি রায়পুরাসহ কয়েকটি ফেরি তলায় সিমেন্ট দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে ডকিং করে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে ১৮ কিলোমিটার দূরত্বের এ নদীপথ চলাচল করছে। অথচ প্রতি বছরের সার্ভে সার্টিফিকেট ছাড়া নৌযান চলাচলে বিধিনিষেধ থাকলেও গত অন্তত ৫ বছর ধরে কোনো ফেরিরই সার্ভে পর্যন্ত করা হয়নি। সূত্র জানায়, চাঁদপুর ও ভোলা নৌরুটে চলাচলরত ঢাকা, কুমিল্লা ও কস্তুরি ফেরি ৩টিও একইভাবে ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলছে।বিআইডবিউটিসির উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, আন্তর্জাতিক মেরিটাইপ সংস্থা আইএমওর কোড অনুযায়ী বাংলাদেশে চলাচলরত ফেরিগুলো ৩০ বছর চলতে পারে। তবে ফেরিস্বল্পতার কারণে মেকানিক্যাল মডিফিকেশনের মাধ্যমে ফেরিগুলো সচল রাখা হয়েছে। তবে সূত্র জানায়, বছর বছর সার্ভে ছাড়া এসব ফেরি চলাচল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এক্ষেত্রে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের সার্ভে বিভাগে চলাচলরত এক লাখ নৌযানের জন্য রয়েছেন মাত্র ২ জন কর্মকর্তা। এ ব্যাপারে আইটি ৩৯০ এর মাস্টার ইনচার্জ শফিকুর রহমান বলেন, পুরোনো ফেরিগুলো দীর্ঘ এ রুটে চালানো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ফেরিচালক বলেন, ‘ফেরি চালানোর ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার লিখেও কোনো প্রতিকার পাই না।’ অনেক ফেরিচালক নৌযানগুলো সার্ভে না করার ফলে নিজেদের সার্টিফিকেট জব্দ হওয়ার শঙ্কায়ও রয়েছেন। মাওয়া জোনের এজিএম আশিকুর রহমান বলেন, পুরোনো এ ফেরিগুলো জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে। ফোনালাপে বাংলাদেশ সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডর (অব.) বজলুর রহমান বলেন, ‘সার্ভে বিভাগে জনবল সংকট রয়েছে। এছাড়াও সম্প্রতি মাওয়া রুটে কিছু নৌযানকে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে। শিগগিরই আমি দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ রুটে গিয়ে সমস্যাগুলো দেখবো।’
0 মন্তব্য(সমূহ):
Post a Comment