11 May 2010 :: 11:22 am
শিবচর 'আমেরিকান সিটিজেন (২৮) স্বামীহারা সন্তানহীন পাত্রীর জন্য দায়িত্ববান পাত্র চাই।' দেশের নামিদামি পত্রিকাগুলোতে এ ধরনের বিজ্ঞাপনের রয়েছে ব্যাপক কদর। অথচ এর আড়ালেই অহরহ ঘটছে প্রতারণা। এবার এ রকমই একটি প্রতারণার শিকার শিবচর পৌর এলাকার সুরুজ মাদবর (৩০)।
সুরুজ মাদবরের আছে স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ে। শিবচর পৌরসভার চরগুয়াতলা বাহেরচরে তাঁর বাড়ি। মৌসুমী ব্যবসায়ী, ভালোই চলছিল সংসার। ইউরোপের যেকোনো দেশে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর দীর্ঘদিনের। এর মধ্যে গত ৮ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় পত্রিকায় মোবাইল ফোন নম্বরসহ 'আমেরিকান সিটিজেন (২৮) স্বামীহারা সন্তানহীন পাত্রীর জন্য দায়িত্ববান পাত্র চাই' লেখা বিজ্ঞাপন পড়ে ফাঁদে পা দেন সুরুজ। যোগাযোগ করলে অপর প্রান্ত থেকে ঢাকায় দ্রুত যোগাযোগের পরামর্শ দেওয়া হয় তাঁকে। ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় কুড়িল বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন এআরএস ৬তলা ভবনের ষষ্ঠতলায় যান সুরুজ। তাঁকে জানানো হয়, কনের আমেরিকায় চারটি বাড়ি এবং ঢাকার বনানীতে ৬ নম্বর রোডে একটি ১২তলা বাড়ি আছে। এ ছাড়া তিনটি তৈরি পোশাক কারখানাও আছে তাঁর। সব শুনে সুরুজ বিয়েতে রাজি হওয়ায় এক হাজার ৭০০ টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়ে কনে দেখাদেখি শেষে ১১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে পাঁচ হাজার টাকা কাবিন খরচ দিয়ে আমেরিকায় বসবাসকারী নাসরীন সুলতানা রিয়ার (৩০) সঙ্গে এফিটেভিটের মাধ্যমে বিয়ে হয় তাঁর। এরপর নিজের ভাগের জমিটুকু বিক্রি করেন। শ্বশুরবাড়ি থেকেও চাপের মুখে টাকা আনেন। গত আড়াই মাসে পাসপোর্ট, ভিসা, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, মার্কেটিং খরচবাবদ প্রায় দুই লাখ টাকা সুরুজের দিতে হয় নতুন স্ত্রী রিয়াকে। এর মধ্যে গত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে রিয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে টাঙ্গাইলের উত্তর সখীপুরে পাঁচ শতাংশ জমি রেজিস্ট্রি করে দেন সুরুজকে। সুরুজও নতুন স্ত্রীকে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা হাতখরচ দেন। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও আমেরিকার ভিসা না হওয়ায় এপ্রিলের মধ্যসপ্তাহ থেকে রিয়াকে চাপ দিতে থাকেন সুরুজ। পরে কাগজ হওয়ার ঘোষণা দিয়ে ১৪ মে ফ্লাইটের কথা জানিয়ে রিয়া ভিসার জন্য আরো এক লাখ টাকা চান। সুরুজ নতুন বিয়ের কথা গোপন রেখে আমেরিকায় যাওয়ার কথা বাড়িতে জানান। চলতি মে মাস থেকে বারবার রিয়া এক লাখ টাকার জন্য চাপ দিতে শুরু করলে সন্দেহ হয়। সুরুজ বিষয়টি তাঁর খালু ইমরান বেপারিকে জানান। পরে খালু ও সুরুজ শলাপরামর্শ করে নিজের কাছে টাকা না থাকার কথা বলে রিয়াকে টাকা নিতে খালুর বাড়ি আসার কথা বলেন। গত শনিবার রিয়া শিবচরে আসার কথা। কিন্তু শুক্রবার সকালে সুরুজ ও তাঁর খালু সুরুজের নামে রেজিস্ট্রিকৃত টাঙ্গাইলের উত্তর সখীপুরে পাঁচ শতাংশ জমি যাচাই করতে গিয়ে দেখেন জমির মালিক সুরুজ নন। আকাশ ভেঙে পড়ে সুরুজের মাথায়। মাথা ঠাণ্ডা রাখার পরামর্শ দেন খালু। শনিবার বেলা ১১টায় সুরুজের সঙ্গে শিবচরে আসেন রিয়া। সেখানে শিকলে বেঁধে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা হলে বেরিয়ে আসে রিয়া নামধারী দুই সন্তানের মা সোনালি দেবনাথের 'আমেরিকান কন্যা' সাজার নানা কাহিনী। রবিবার আশেক নামের রিয়ার এক আত্মীয় সুরুজকে ২৫ হাজার টাকা ফেরত দিয়ে গেছেন। সোমবার রাত আড়াইটায় কথিত সোনালি দেবনাথকে সুরুজের বাড়ি থেকে উদ্ধার করে শিবচর থানার পুলিশ।
প্রতারণার শিকার সুরুজ মাদবর বলেন, 'আমি অনেক দিন ধরেই বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করতাছি। এ জন্য জমিও বিক্রি করছি। শ্বশুর বাড়িতেও টাকা চাইছি। গত ৮ ফেব্রুয়ারি একটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেইখা যোগাযোগ করি। সবার অজান্তেই রিয়াকে বিয়ে করি। টাকা দেই। সবাই আমার সাথে এত সুন্দর অভিনয় করে, বুঝতে পারি নাই সব সাজানো।'
সুরুজের স্ত্রী লুবনা বেগম বলেন, 'আমার দুই সন্তান। অবস্থাও খারাপ না। এর পরও সে এগুলা কইরা ধরা খাইল। এই মহিলা আরো অনেক যুবকের জীবন নষ্ট করছে। দৃষ্টান্তমূলক বিচার হওয়া উচিত।'
সুরুজের খালু ইমরান বেপারি বলেন, 'বিষয়টি জানার পর আমার খটকা লাগে। এরপর আমি ও সুরুজ যাচাই করে বুঝতে পারি এটি ভূয়া। মেয়েটি বড় কোনো চক্রের। বিষয়টি খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত।'
রিয়া রূপী সোনালি দেবনাথ বলেন, 'যে টাকা নিই, তার ১০ ভাগ টাকা আমি পাই, বাকিটা মিডিয়া অফিসের মাহমুদ, তারেক, নাজমারা নেয়। আমার মতো আরো অনেক মেয়ে কানাডা, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের সিটিজেন পরিচয়ে এই কাজ করে। শারীরিক গঠন সুন্দর মেয়েরাই এ কাজে আসে। আমাকে দিয়ে এ পর্যন্ত ৮-১০ জন যুবকের সঙ্গে প্রতারণা করানো হয়েছে।'
শিবচর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আ. জলিল বলেন, 'মেয়েটি বড় ধরনের প্রতারক চক্রের সদস্য। আমরা বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করছি। তবে যুবকটিও ভালো না। কারণ, সে প্রথম স্ত্রীকে না জানিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। আবার কথিত স্ত্রী রিয়াকে তিনদিন শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে। এ ব্যাপারে মামলার প্রস্তুতি চলছে।'
