16 May 2010 :: 02:14 pm
বিদ্যালয়ে দেয়াল ঘেঁষে মলিন মুখে দাঁড়ানো একটি ছেলে। দেখেই মনে হলো, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে। 'মন খারাপ করো না। রেজাল্ট খারাপ হয়েছে তাতে কি?'_এ কথা বলতেই ছেলেটি মৃদু হেসে বলল, 'স্যার আমার নাম সুজন। জিপিএ ৫ পেয়েছি। কিন্তু ইতিমধ্যেই লেখাপড়া ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে কম্পিউটার দোকানে কাজ শিখছি তো। তাই ভাবছি, এ রেজাল্ট ও সনদ দিয়ে কী করব?'
এভাবেই নিজের অনুভূতি জানায় শিবচরের খানকান্দি সৈয়দ আশরাফ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র সুজন চন্দ্র সূত্রধর। প্রাইভেট পড়িয়ে ও দর্জি পিতা সুদেব সূত্রধরকে সহযোগিতা করে খেয়ে-না খেয়েই সাফল্য পেয়েছে সুজন।
শিবচর পৌর এলাকার নলগোড়ায় সুজনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দেড় শতাংশ জমিতে পাটকাঠির বেড়ার ঘর। জরাজীর্ন ঘরে নেই কোনো পড়ার টেবিল। পরিবারের সবার পরনের পোশাক দেখে সহজেই বোঝা যায়, নুন আনতে তাদের পান্তা ফুরায়।
জানা গেল, অন্যের দোকানে দর্জির কাজ করে সুজনের বাবা সুদেব সূত্রধরের দৈনিক আয় ৭০ থেকে ১০০ টাকা। মা ইলা রানী অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। মাঝেমধ্যে কাজ করেন একটি বেসরকারি সংস্থায়। অন্যের বাড়ি কাজের বিনিময়ে পাওয়া কাপড়ই তাঁর সম্বল। ছেলের সাফল্যেও মায়ের চোখে যেন অন্যরকম এক বিষাদ। একটি মাত্র শার্ট-প্যান্ট পরেই ক্লাস করতে হতো সুজনকে। কখনো পান্তা খেয়ে আবার কখনো এক গ্লাস পানি খেয়ে যেতে হতো ক্লাসে। বেশির ভাগ বই বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে পড়ত। কেরোসিনের অভাবে প্রায় রাতেই পড়তে পারত না। তাই সূর্যের আলোই ছিল তার ভরসা।
সুজন বলে, 'আমি অনেক কষ্ট কইরা খাইয়া-না খাইয়া পড়ছি। আমার ডাক্তার হইতে ইচ্ছা করে। কিন্তু বাড়ির কেউ তো পেট ভইরা খাইতেই পারি না। পড়মু কেমনে? আমার স্কুল থেকে আমার কোনো বেতন নেয় নাই। স্যাররাও অনেক সহযোগিতা করছেন। বন্ধুরাও বই হাওলাদ দিছে পড়তে।'
মা ইলা রানী কাঁদতে কাঁদতে বলেন, 'আজ সকালেও আমার ছেলেডা না খাইয়া রেজাল্ট আনতে গেছে। জন্মের পর ওগো কোনোদিন পেট ভইরা মুখে কয়ডা ভাতও দিতে পারি নাই। শুধু কোনো আত্দীয়ের অনুষ্ঠানে মাংস-পোলাও চোহে দেখছে। অভাবের কারণে সুজন লেখাপড়া ছাইড়া এহন কম্পিউটারের দোকানে কাম শিখতাছে।'
বাবা সুদেব বলেন, 'ওর মা-ই মাইনষের কাছ থিকা চাইয়া চাইয়া কোনোমতে পুলাডারে পড়াইছে। এত গরিব মাইনষের পুলা কি আর পড়তে পারে? আমার পুলাডা পড়ার সুযোগ পাইলে ঠিকই ডাক্তার হইতে পারত।'
সৈয়দ আশরাফ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক এ কে এম নাসিরুল হক বলেন, 'সুজন সুযোগ পেলে যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারত। কিন্তু দারিদ্র্যের কষাঘাতে ওরা নিষ্পেষিত। দুই বেলা খেতেই পায় না। কারো সহযোগিতা ছাড়া তার লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।'
