যৌতুক না পেয়ে ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার চরব্রাহ্মণদী গ্রামে নুরজাহান বেগম (২০) নামের এক গৃহবধুকে হত্যা করেছে পাষণ্ড স্বামী । এ মৃত্যুতে স্বামীর অত্যাচারের বিষয়টি পুলিশ নিশ্চিত হয়েও ঘাতক স্বামী রাজ্জাক পুলিশের সামনে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেনি। নিহত নুরজাহান দৈনিক নয়া দিগন্তের ঢাকা বিভাগীয় সম্পাদক ও সাব এডিটর হাসান পারভেজ হৃদয়ের ছোট বোন।
এলাকাবাসী ও পারিবারিক সূত্র জানায়, গত দুই মাস আগে (৫ ফেব্রুয়ারি) মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার সন্ন্যাসীরচরের আ. হামিদ হাওলাদারের ছোট মেয়ে নুরজাহান বেগমের সাথে ফরিদপুর জেলার সদরপুরের চরব্রাহ্মণদী গ্রামের আ. খালেক আকনের ছেলে রাজ্জাক আকনের বিয়ে হয় । বিয়ের সময় রাজ্জাকের দাবী অনুযায়ী তাকে শ্বশুর বাড়ির পক্ষ থেকে একটি নতুন মটরসাইকেল ও কন্যাকে গহনা দেয়া হয়। কিন্তু বিয়ের দিন শ্বশুরালয়ে এসে যৌতুকলোভী আরো ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। কিন্তু এ টাকা দিতে শ্বশুর বাড়ি থেকে আপত্তি জানালে বিয়ে বাড়িতেই কলহ হয়। অবশেষে রাজ্জাক নববধু ও নতুন মটরসাইকেল নিয়েই নিজ বাড়িতে আসে । কিন্তু বাসর রাতেই নুরজাহানের ভাগ্যে নেমে আসে বর্বর অত্যাচার। সারারাত বাইরে বসিয়ে রেখে পরদিনই নুরজাহানকে ফেরৎ পাঠানো হয় বাবার বাড়ি। তাও নুরজাহানের ভাবীকে রাজ্জাকের বাড়ির সকলের সামনে করজোড়ে মাফ চেয়ে ফেরৎ আনতে হয়। পরে এ নিয়ে দীর্ঘ সালিশ বৈঠকের পর সদরপুরের প্রভাবশালী নেতা মনির মীরের মধ্যস্থতায় ৭ দিন পর নুরজাহানকে শ্বশুর বাড়িতে ফেরৎ আনা হয়। এরপরই শুরু হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। বারবার যৌতুক দাবি করে রাজ্জাক নুরজাহানকে হত্যার হুমকি দেয়। এরই সূত্র ধরে সোমবার মধ্যরাতে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে নুরজাহানের মুখ গামছা দিয়ে বেধে চুল বাঁধার ফিতা দিয়ে গলায় পেচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখে পাষণ্ড রাজ্জাক। নুরজাহানকে হত্যার পর তৈরি করা হয় আত্মহত্যা নাটকের। ডাকা হয় প্রতিবেশীসহ চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্যদের। আর এ সকল মানুষদের ও পরিবারের সদস্যদের দেয়া তথ্যেও ছিল বিস্তর গড়মিল।
সরেজমিনে রাজ্জাকের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির উঠানে শোয়ানো নুরজাহানের নিথর মৃতদেহ। তার মুখ গামছা দিয়ে বাধা ও গলায় চুল বাধার ফিতা পেচানো । দুই চৌকিদার হারিছ মিয়া ও নিয়ামত আলীসহ ইউপি চেয়ারম্যান আবু জাফর বসা।
ইউপি চেয়ারম্যান আবু জাফর পরিবারটি ও রাজ্জাকের ব্যাপারে বিরূপ মন্তব্য করে বলেন, খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে আসি। ওসির পরামর্শে দরজা ভেঙ্গে লাশটি উদ্ধারের নির্দেশ দেয়ার কিছুক্ষণ পর দেখি চৌকিদার দুজন ভেতরের কাটা টিনের বেড়া দিয়ে দরজা খুলেছে। ঘরের ভেতরে যেয়ে দেখি নুরজাহানকে সোফার উপর হাঁটু ভাঙ্গাবস্থায় ঝুলানো ও পাশের টিন কাটা দেখি। যেভাবে হাঁটু ভেঙ্গে সোফার উপর ছিল। কিভাবে এতে ফাঁস খায় বুঝতে পারলাম না।
নিয়ামত চৌকিদার ও হারিছ মিয়া টিনের বেড়াটি নিজেরা কাটেননি তবে হাত দিয়ে টেনে ছিড়েছেন বলে বলেন, আমরা প্রথমে সামনের দরজা ভাঙ্গতে চেষ্টা করেছি, না পেরে টিনের বেড়া হাত দিয়েই টেনে ছিড়েছি। তবে টিন কাটা বা ছেড়ার বিষয়টি উঠানে বসা ইউপি চেয়ারম্যান দেখেননি বলে জানান। এলাকাবাসীর ধারণা হত্যাকাণ্ডটি ধামাচাপা দিতে নুরজাহানকে হত্যার পর টিন কেটে গা ঢাকা দেয় রাজ্জাক।
এ ব্যাপারে সদরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী বলেন, মুখে গামছা পেঁচানো এবং গলায় ফিতা পেচানো অবস্থায় নুরজাহানের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। মেয়েটির কোমড়ে একটি চিরকুট পাওয়া গেছে। যাতে লেখা রয়েছে 'আমার এক চোখে কাঁদায়, এক চোখে ঘুম আসে। মুখে যা আসে তাই বলে, মারামারি করে প্রতিদিন।'
উপস্থিত দুই চৌকিদারকে দিয়ে আপাতত অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়েছে। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ফরিদপুর মর্গে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট পাওয়ার পর মূল মামলা দায়ের হবে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকাবাসী জানান, রাজ্জাক চরম বখাটে। ওর এক ভাই ভারতে পলাতক। আরেক ভাই আদম ব্যবসায়ী। সেও পলাতক। রাজ্জাক বিয়ের পর প্রতিদিনই বউকে মারধর করতো।
এদিকে নুরজাহানের পরিবারে কান্নার রোল পড়েছে । মেয়েকে হারিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা রহিমুন্নেছা। বাকরুদ্ধ পিতা। বোনকে হারিয়ে ছোট ভাই আবুল হোসেনের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষ অনিশ্চিত।
নুরজাহানের ভাই সাংবাদিক হাসান পারভেজ হৃদয় জানান, যৌতুকের কারণে ধারাবাহিক নির্যাতনের পর ওরা আমার বোনকে মেরেই ফেললো। পুলিশ হাতের কাছেও রাজ্জাককে পেয়েও ধরেনি। বরং ওর ভাগ্নে পুলিশের সামনেই আমাদের উপর হামলা চালিয়েছে। পুলিশ যেন দর্শক। আমার বোনের গলায় চিকন দড়ির ফাঁসসহ মুখ বাধা ছিল। দুই হাত, সারা শরীর নীল বর্ণ। শরীরের বিভিন্ন অংশে মাংস ও রক্ত জমাট বাধা। পেটে আঘাতের চিহ্ন। বাম গালের পাশে ছিট ছিট। এরপরও পুলিশের সামনে দিয়ে ঘাতক রাজ্জাক ঘুরে বেড়ালো পুলিশ ধরলো না।