ইউরোপে বাংলাদেশ
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম হাবিবী, (লন্ডন থেকে)
১৬ তারিখ থেকে দুই সপ্তাহের জন্য ইংল্যান্ডের স্কুল কলেজ বন্ধ। ইস্টার হলি ডে। শনি ও রবিবার আমি একটি বাংলা স্কুলে শিক্ষকতা করি বিধায় বাইরে যাওয়া হয় না। স্কুলটি আমার বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে। নাম 'বাংলাদেশ কালচারাল সোসাইটি স্কুল'। আমরা এখানে বাংলা-আরবির পাশাপাশি আবৃত্তি ও গান শেখাই। এ ধরণের স্কুলের জন্য স্থানীয় সরকার (বরা) আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে না। ছেলে এবং স্ত্রী অনেকটা অসুস্থ। বাসার সব কাজই আমাকে করতে হয়। এ দেশে বাসা-বাড়িতে কাজের ছেলেমেয়ে রাখা শতকরা ৯০ জনের পক্ষে সম্ভব নয়।
আমি একটি কলেজে কাজ করি এবং পিএইচডির স্বপ্ন নিয়ে অক্সফোর্ডে যাই। যার কারণে লন্ডনের এই প্রবাসজীবন আমার কাছে অনেকটা কঠিন। এখানে অনেক কষ্ট, যা হয়ত বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করতে চাইবে না। এদিকে সুন্দর আবহাওয়া, মন বলে বাইরে যাই। গাছে মুকুলিত হচ্ছে কিশলয়, ভেতরে ভেতরে রেণু-পরাগের লুকোচুরি অসম প্রেমের নতুন চিঠির মত। ছেলেমেয়েকে নিয়ে পার্কে যাই। নাম 'হারেঙ্গে সিভিক সেন্টার পার্ক'। উল্লেখ্য যে, এদেশের পার্কগুলি ছিমছাম পরিপাটি, সুন্দর, সাজানো-গুছানো। ছেলেমেদের বিনোদনের যাবতীয় সুব্যবস্থা এখানে করা থাকে। লন্ডনে অনেকগুলি বড় ছোট পার্ক আছে। কিন্তু সুবিধাদি প্রদানের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ কোন শ্রেণী-বিন্যাস করে না। জাত-গোষ্টির বিতর্ক নেই।
পার্কের ভেতর ফুলের বাগান, ফুটবল খেলার মাঠ, প্লাস্টিক বা লোহার চেয়ার টেবিল খেলাধুলার নানান সরঞ্জামাদি দেখে মনে হবে আপনি কোন এক বিশেষ আবেষ্টনীর আবহে আছেন। আমি বলি, British park is for Think, Thing and Sing. দেখার, উপভোগ করার এবং মনের সুখে বসে গান করার মত নির্জন স্থান আর হয় না। বসে থাকুন একা অথবা মহিলা-বন্ধুর কোলে, না কারো কোন শ্যেনদৃষ্টি নেই। নেই মামা-মাতব্বরের রক্তচক্ষু।
কুকুরের বিষ্টা ফেলার আলাদা ব্যবস্থা, একটি কলা খেলে তার বাকলটি কোথায় ফেলবেন, কোন রঙের বোতল-গ্লাস, কাগজ (পাতলা-মোটা), টিনের বোতল, কাপড়-চোপড় কোথায় ফেলবেন তার জন্য নির্দিষ্ট 'বিন' বসানো আছে। 'বিনে'র গায়ে লেখা থাকে, যদি কোন কারণে 'বিন' নষ্ট হয়, খোলা না যায় অথবা আবর্জনায় ভরে ওঠে, আপনি কাকে (ফ্রি) ফোন করবেন। লেখা থাকে, সপ্তাহের কোনদিন এবং কখন লরি এসে তা নিয়ে যাবে।
পার্কে কোন গার্ড বা মালি নেই। পুলিশের ডান্ডা এবং নেতার কিল-ঘুষির কোন ভয় নেই, তারপরও সব আছে। মনে হয় আমাদের কেউ দেখছে। এক অদৃশ্য শক্তি যেন আমাদের শাসন করছে। চকলেটের একটি ছোট কাগজও যেখানে সেখানে ফেলতে মন চায় না। অপরাধবোধ, লজ্জা, রীতি-নীতি, রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা যেন বিবেক ধরে টানে। পথে- ঘাটে কিছু ফেলা তো দূরের কথা এদেশের মানুষ চলার পথে কোন কাগজ-ময়লা দেখলে তা নিজের হাতে তুলে নিয়ে নির্ধারিত 'বিনে' ফেলে আনন্দ লাভ করে। আমাদের ঘরের বাইরের দরজা পর্যন্ত সরকারি দায়িত্বে সপ্তাহে একবার পরিস্কার করা হয়। এর পরও আমরা একটি শুষ্ক পাতাও উঠোনে পড়তে দেই না। নিজের হাতে যখন এ রকম কাজগুলি আমরা করতে পারি তখন আমাদের ভাল লাগে। মনে হয়, আজ একটি সুন্দর এবং সমাজ সেবামূলক কিছু করা হল।
আমার মনে পড়ে ২০০৬ সালের কথা। সেবার আমি দেশে গিয়েছিলাম। বিস্কেটের খালি একটি প্যাকেট এবং খালি একটি পানির বোতল কোনোখানে ফেলার জন্য 'বিন' না পাওয়ায় আমার ব্যাগে করে দীর্ঘক্ষণ পথ হেঁটেছি। আমার সাথে আমার কিছু বন্ধু-আত্মীয় ছিল। তারা জানতে চাইল কেন আমি সে সব ফেলছি না। বললাম, আমি একটি 'বিন' এর সন্ধান করছি। তারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে জানতে চাইল আমি ঠিক মত আছি কিনা! হয়ত তাদের ধারণা, আমার মাথার কোন অংশে সমস্যা আছে। বন্ধুদের মধ্যে ভার্সিটিতে পড়ুয়া সরকারি বড় কর্মকর্তাও ছিল। সেই-ই এক ধরণের বিদ্রূপের ছলে বলল 'ফেলে দে এখানে, এটা লন্ডন নয়'।
'অতীত তুমি ভুবনে ভুবনে/ কথা কয়ে যাও গোপনে গোপনে'। আজ থেকে চার বছর আগের কথা। ছেলেমেয়েদের সাথে এখন পার্কে। বিকাল বেলা। বাসায় ফিরতে হবে। গাছের মগডালে কয়েকটি পাখির কূজন। অন্য পাখিরা কোথায় যেন দূরে উড়ে যাচ্ছে। মন বলে দেশে যাই। ফিরে যাই মা-বাবার কোলে, শাপলা জলে, শিমুল তলে, ঘাসের ঘ্রাণে, ফড়িং এর গানের দেশ-আমার সোনার বাংলাদেশে। আবেগ থেমে যায়। নিজেকে অপরাধী ভাবি। যদি বন্ধুদের বুঝাতে না পারি যে, বাংলাদেশ সুন্দর একটি দেশ, এ আমাদের মায়ের দেশ। আমরা মাকে যেমন ভালবাসি ঠিক তেমনি দেশকেও ভালবাসতে হবে, মা এর গায়ে একটি ধুলোও পড়তে দেব না, পড়লে হাত দিয়ে আদরে তা মুছে দেব। বলব, 'মা তোর বদন খানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি'।-এটাই যে মাতৃভক্তি। দেশপ্রেম! না আর পারি না। বন্ধুরা আবার বলবেন, 'রাখ ও সব, এটি লন্ডন নয়'!
লেখক, লন্ডনের স্থায়ী বাসিন্দা। পড়াশুনা করছেন অক্সফোর্ডে। প্রকাশিত গ্রন্থ ১০টি।
sagarsahara@hotmail.com


0 মন্তব্য(সমূহ):
Post a Comment